জড়তাকে পরিবর্তন করতে ব্যাবহার করা হয় বল। বল প্রয়োগের মাধ্যমেই মূলত আমরা সকল কাজ কর্ম করে থাকি। আপাতত এতটুকু আমরা সবাই জানি। কিন্তু একজন তৃষ্ণার্ত শিক্ষার্থীর জ্ঞানকে এখানে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। যেকোনো বিষয় খুব ভালো করে সুনির্দিষ্ট ভাবে জেনে নেওয়া উচিত। সেই লক্ষ্যে, আজ আমরা বল কি সেই জিনিসটাকে জেনে নেব আরেকটু ভালো করে।
Table of contents
বল কাকে বলেঃ
যার প্রয়োগের কারণে স্থির বস্তু চলতে শুরু করে আর সমবেগে চলতে থাকা বস্তুর বেগের পরিবর্তন হয় সেটাই হচ্ছে বল
আসলে নিউটনের প্রথম সুত্রকেই বলের সঙ্গা বলা হয়। নিউটনের প্রথম সূত্রে তিনি জড়তা বা Inertia সম্পর্কে একটি ধারণা দিয়েছিলেন। জড়তা হলো, কোনো বস্তু যেই অবস্থায় আছে ঠিক সেই অবস্থায়ই থাকার প্রবণতা। যেমন: যদি কোনো বস্তু স্থির থাকে তাহলে ঠিক একইভাবে স্থির থাকতে চাওয়ার প্রবণতা এক ধরনের জড়তা হতে পারে। এবং এই কথাটা গতিশীল বস্তুর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। অর্থাৎ গতিশীল বস্তুর গতিশীল থাকার প্রবণতাও জড়তা। আর এরূপ অবস্থাকে পরিবর্তন করা সম্ভব হয় বল এর মাধ্যমে।
মূল কথা হচ্ছে, এই জড়তা জনিত অবস্থা ভাঙতে আমরা যে জিনিসটি প্রয়োগ করি তাই বল। আমরা এভাবেও বলতে পারি, বল স্থির বস্তুকে গতিশীল করে এবং গতিশীল বস্তুর গতির পরিবর্তন ঘটায়।
বলের একক N (Newton/নিউটন) বা Nm2kg-2।
বল একটি ভেক্টর রাশি। তাই বলের মান ও দিক উভয়ই রয়েছে। কেননা আমরা যেকোনো বল প্রয়োগ করি নির্দিষ্ট একটা দিকে। এবং অবশ্যই কতটুকু বল প্রয়োগ করা হলো তারও পরিমাপ আছে। যেমন:
দুটি 1 kg ভরের বস্তুকে 1 m দূরত্বে স্থাপন করলে তারা পরস্পরকে নিজের দিকে 6.673×10-11 Nm2kg-2 বল -এ আকর্ষণ করে।
বলের ইংরেজি প্রতিশব্দ Force.
বল কত প্রকারঃ
পৃথিবীতে অসংখ্য রকমের বল আছে। তবে এর মধ্যে কয়েকটি মৌলিক বল রয়েছে। যার মাধ্যমে সঙ্গায়িত করা সম্ভব অন্য সকল বল -কে। তাই আপাতত আমরা মৌলিক বলের প্রকৃতি সম্পর্কে জেনে নেব।
প্রকৃতিতে প্রধানত মৌলিক বল চারটি। যথা:
- মহাকর্ষ বল,
- তড়িৎ চৌম্বক বল বা বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় বল,
- দুর্বল নিউক্লিয় বল এবং
- সবল নিউক্লিয় বল।
আমরা দৈনন্দিন জীবনে বলের যেসব উদাহরণ সমুহ দেখি, সেগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে সেই বলটি এই চারটি মৌলিক বলের মধ্যেই কোনো একটিতে অবস্থান করছে। তো এবার জেনে নেয়া যাক এই চারটি বল সম্পর্কে।
আরো পড়ুন
কাজ কি? কাজের একক, মাত্রা, প্রকারভেদ এবং সূত্র
ক্ষমতা কি, ক্ষমতার একক, মাত্রা, উদাহরণ এবং সূত্র
মহাকর্ষ বলঃ
এই সৃষ্টি জগতের যেকোনো দুইটি বস্তু তাদের ভরের কারণে একে অপরকে যে বল দিয়ে আকর্ষণ করে তাকে মহাকর্ষ বল বলে
গুরুত্বপূর্ন বিষয় হচ্ছে, মহাকর্ষ বল সর্বদাই আকর্ষণ ধর্মী। এ বলের কোনো বিকর্ষণ নেই।
অনেক সময় মনে হতে পারে মহাকর্ষ বল বুঝি প্রকৃতিতে নেই। কিন্তু আসলে সেটি সত্যি নয়। মহাকর্ষ বল অবশ্যই আছে। তা নাহলে গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্রের মাঝে এমন স্থিতিশীল অবস্থা বজায় থাকতো না। একটি অন্যটির উপর খসে পড়ত! তবে প্রকৃতপক্ষে, মহাকর্ষ বলের শক্তি অনেক কম। সেজন্য হয়তো মহাকর্ষ বল নেই, এরূপ ধারণা আসতে পারে।
মহাকর্ষ বল কার্যকর হয় মহাবিশ্বের যেকোনো দুটি বস্তুর মধ্যে। যেমন: একটি গ্রহের সাথে অন্য একটি গ্রহের আকর্ষণ, সূর্য ও বুধ গ্রহের আকর্ষণ। আবার তুমি নিজে এবং তোমার মোবাইল ফোনটিও কিন্তু মহাবিশ্বের দুটি বস্তু। তাই তোমাদের মধ্যেও নিশ্চয়ই মহাকর্ষ বল নামক এই আকর্ষণ বল রয়েছে। যদিও আমরা সেটি অনুভব করতে পারি না। কেননা আগেই বলা হয়েছে, মহাকর্ষ বলের শক্তি অনেক কম। মহাকর্ষ বল অনুভূত হওয়ার জন্য প্রয়োজন অনেক বেশি ভরের বস্তু। যেমন: পৃথিবীর ভর অনেক বেশি। তাই পৃথিবী এবং তোমার মাঝের মহাকর্ষ বলটি বোঝা যায়। এই আকর্ষণ বলটির কারণেই তুমি লেগে আছো পৃথিবী পৃষ্ঠে।
মহাকর্ষ বলের ইংরেজি প্রতিশব্দ Gravitation.
[জেনে রাখো: মহাকর্ষ বলের আকর্ষ বস্তুটির একটি যদি পৃথিবী হয় তবে তাকে মাধ্যাকর্ষণ বা অভিকর্ষ বল বলে।]
তড়িৎ চৌম্বক বল বা বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় বলঃ
তড়িৎচুম্বকীয় ক্ষেত্র আহিত বস্তুর উপর যে বল প্রয়োগ করে তাকে তড়িতচৌম্বক বল বলে
অর্থাৎ বিদ্যুৎ এবং চুম্বকের মাঝে আমরা যেই বলটি দেখি সেটি হচ্ছে বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় বল। দুটি চার্জ পাশাপাশি থাকলেই সেখানে আকর্ষণ বল কাজ করবে। আর একেই তড়িৎ চৌম্বক বল বলা হয়। যেমন: দুটি চুম্বকের আকর্ষণ। বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় বলের আকর্ষণ এবং বিকর্ষণ উভয় ধর্মই রয়েছে। দুটি চার্জ আবার পরস্পরকে বিকর্ষণও করতে পারে। এক্ষেত্রেও তাকে বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় বল নামেই ডাকা হবে। যেমন: দুটি চুম্বকের মেরু একই হলে তারা পরস্পরকে বিকর্ষণ করে। এছাড়াও বিপরীত ধর্মী চার্জ পরস্পরকে আকর্ষণ করে এবং সমধর্মী চার্জ পরস্পরকে বিকর্ষণ করে।
চুম্বক বল এবং বিদ্যুৎ বলের মৌলিক কনসেপ্ট একই হওয়ায় এদের মূলত একটি বল হিসেবেই ধরা হয়। কেননা বল দুটোরই আকর্ষণ বিকর্ষণ একই নিয়ম মেনে চলে ও বিদ্যুৎ থেকে চুম্বক এবং চুম্বক থেকে বিদ্যুৎ তৈরি করা যায়।
বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় বল কিন্তু অনেক শক্তিশালী একটা বল। যা প্রায় মাধ্যাকর্ষণ শক্তি থেকে 1036 গুণ বেশি। চিন্তা করে দেখ এটি প্রায় ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন গুণ! তবে তড়িৎ চৌম্বক বলের রেঞ্জ অনেক কম। অর্থাৎ এর আকর্ষণ ক্ষেত্র অনেক ছোট।
এর ইংরেজি প্রতিশব্দ Electromagnetic Force.
দুর্বল নিউক্লিয় বলঃ
যে বলের কারণে নিউক্লিয়াস থেকে ইলেকট্রন নির্গত হয় অর্থাৎ পরমাণু তার তেজস্ক্রিয়তা ধর্ম প্রদর্শন করে এবং পরমাণু স্থিত মৌলিক কনা সমূহের মধ্যে সমন্বয় করে তাকে দুর্বল নিউক্লিয় বল বলে।
নাম দেখেই বোঝা যাচ্ছে, দুর্বল নিউক্লিয় অনেকটা কম শক্তিশালী। তবে নিউক্লিয় বলের এই হিসেবটা করা হয়েছে তড়িৎ চৌম্বকীয় বলের মানকে স্ট্যান্ডার্ড ধরে। অর্থাৎ দুর্বল নিউক্লিয় বল তড়িৎ চুম্বকীয় বল থেকে অধিকতর কম শক্তিশালী (প্রায় ট্রিলিয়ন গুণ কম শক্তিশালী)। তবে তা অবশ্যই মহাকর্ষ বলের থেকে শক্তিশালী।
দুর্বল নিউক্লিয় বল সবচেয়ে কম দূরত্বে কাজ করে। যা মাত্র 10-18 m.
দুর্বল নিউক্লিয় বলের কারণে আলফা, বিটা, গামা রশ্মি নির্গত হয়।
এর ইংরেজি প্রতিশব্দ Strong Nuclear Force.
সবল নিউক্লিয় বলঃ
মৌলিক বলের মধ্যে সবল নিউক্লিয় বল হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী। অর্থাৎ এই বলটি তড়িৎ চুম্বকীয় বল থেকেও বেশি শক্তিশালী(প্রায় 1038 গুণ বেশি শক্তিশালী)। তবে এটা যেহেতু এক ধরনের নিউক্লিয় বল তাই এর আকর্ষণ ক্ষেত্র অনেক কম। এই বলটি মাত্র 10-15 মিটার দূরত্বে কাজ করে।
আমরা জানি পরমাণুর কেন্দ্রে ধনাত্মক চার্জ বিশিষ্ট অনেকগুলো প্রোটন থাকে। প্রশ্ন হচ্ছে যেহেতু সমধর্মী চার্জ পরস্পরকে বিকর্ষণ করে তাহলে এসব সমধর্মী প্রোটন পরমাণুর কেন্দ্র থেকে ছুটে বেরিয়ে আসছে না কেনো? এই কাজটি সম্ভব হচ্ছে এই সবল নিউক্লিয় বলের কারণে!
এছাড়াও পারমাণবিক বোমা কিন্তু ঠিক এই কনসেপ্ট থেকেই তৈরি করা হয়েছে। প্রথমে সবল নিউক্লিয় বল দ্বারা অনেকগুলো সমধর্মী চার্জকে একত্র করা হয়। এবং বোমা ফাটানোর সময় বিক্রিয়া করে এই বল নিষ্ক্রিয় করা হয়।
এসব মৌলিক বলের সমন্বয়ে তৈরি তৈরি হওয়া নানা প্রকারের বলকে যৌগিক বল বলে।
আশা করি তোমরা বিষয়টা বুঝতে পেরেছো। বিষয়টি আসলে অনেক সহজ। তবে অনেক শিক্ষার্থী বিষয়টিকে জটিল করে ফেলে। তোমাদের একবার পড়ে বুঝতে অসুবিধা হলে কষ্ট করে আরেকবার পড়ে নাও, সহজেই বুঝে যাবে। আর এবিষয়ে কোনো সমস্যা থাকলে অবশ্যই কমেন্টে লিখে জানাও। ইনশাল্লাহ উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব। ভালো লাগল বন্ধুদের মাঝে শেয়ার করতে পারো। এরকম আরো তথ্যপূর্ণ কন্টেন্ট পেতে ঘুরে দেখতে পারো পুরো সাইট। আজ এই পর্যন্তই। আসসালমুআলাইকুম।
আমরা ভালো থাকবো - দেশকে ভালো রাখবো
বল কাকে বলে?
যার প্রয়োগের কারণে স্থির বস্তু চলতে শুরু করে আর সমবেগে চলতে থাকা বস্তুর বেগের পরিবর্তন হয় সেটাই হচ্ছে বল।
মৌলিক বল কত প্রকার?
মৌলিক বল চার প্রকার।
বলের শক্তির ক্রম দেখাও
মহাকর্ষ বল>দুর্বল নিউক্লিয় বল>তড়িৎ চুম্বকীয় বল>সবল নিউক্লিয় বল
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন