আমরা রসায়নে যখন পদার্থের গঠন নিয়ে আলোচনা করি, তার শেষের দিকে আইসোটোপ কি, আইসোটোপের ব্যাবহার, তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ ও তাদের ব্যবহার এইসকল টপিকগুলো নিয়ে আলোচনা করি। তবে তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ নিয়ে পড়াশোনার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। পদার্থের গঠন অধ্যায়ের সৃজনশীলের 'ঘ' নং প্রশ্নের ক্ষেত্রে আলোচ্য বিষয়টি অনেকটাই কমন। অধ্যায়ের সৃজনশীল প্রশ্নের ৪০% এই তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ ও তাদের ব্যবহার থাকে, তাই আমি মনে করি, এই পাঠটি তোমাদের অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে পড়া উচিৎ। আর এই টপিকটি আলোচনা করা হয়েছে এই পোস্টে। তাই আশা করি পোস্টটি পড়ে উপকৃত হবে।
তো চলো এবার মূল কথায় আসা যাক। তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ ও তাদের ব্যাবহার সম্পর্কে জানার আগে আমরা দুটি বিষয় জেনে নেব। তা হলো আইসোটোপ বলতে কি বোঝায় আর তেজস্ক্রিয় শব্দটির অর্থ কি?
আইসোটোপ
আইসোটোপ বলা হয় ঐসকল পর্মানুসমুহকে প্রোটন সংখ্যা সমান কিন্তু নিউট্রন সংখ্যা ও ভর সংখ্যা ভিন্ন।
অর্থাৎ যদি কয়েকটি পরমাণুর প্রোটন সংখ্যা একই হয় তাহলে পরমাণুগুলো একটি অপরটির আইসোটোপ। যেমন: পাঁচটি পরমাণুর প্রোটন সংখ্যা 3. অতএব পরমাণু পাঁচটি একটি অপরটির আইসোটোপ। উদাহরণ হিসেবে, আমরা যদি 155X, 165X, 175X[X কোনো মৌল নয়, উদাহরণের ক্ষেত্রে প্রতীকী অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে] তিনটি পরমাণুর কথা বিবেচনা করি তাহলে দেখা যায় তিনটি পরমাণুরই প্রোটন সংখ্যা 5। তাহলে পরমাণু তিনটি পরস্পরের আইসোটোপ। আমরা আরেকটু লক্ষ্য করলে দেখবো পরমাণুগুলোর ভরসংখ্যা 16, 15, 17 যা ভিন্ন তিনটি সংখ্যা। অর্থাৎ আইসোটোপ হতে হলে পরমাণুর ভরসংখ্যা ভিন্ন হওয়া যাবে কিন্তু প্রোটন বা পারমাণবিক সংখ্যা অবশ্যই সমান হতে হবে।
তেজস্ক্রিয়:
স্বাভাবিকভাবে শক্তিশালী রশ্মি নির্গত হওয়া। অর্থাৎ যদি কোনো পদার্থ থেকে এমন শক্তিশালী রশ্মি বা কণা নির্গত হয় তবে তাকে তেজস্ক্রিয় পদার্থ বলে।
তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ:
এটুকু আলোচনা থেকে এখন আমরা বলতে পারি, যেসকল আইসোটোপের নিউক্লিয়াস স্বত:স্ফুর্তভাবে ভেঙে শক্তিশালী রশ্মি বিকিরণ করে তাদেরকে তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ বলে। এখানে শক্তিশালী রশ্মি— আলফা রশ্মি, বিটা রশ্মি, গামা রশ্মি ইত্যাদিকে বোঝানো হয়েছে।
তথ্য মতে, এখন পর্যন্ত তিন হাজার থেকে বেশি সংখ্যক আইসোটোপ সম্পর্কে জানা সম্ভব হয়েছে। আইসোটোপ গুলোর কিছু প্রকৃতিতে পাওয়া গেছে আর বাকিগুলো রসায়ন গবেষণাগারে তৈরি করা হয়েছে।
আরো পড়োঃ
সংকেত কাকে বলে, সংকেত লেখার নিয়ম এবং উদাহরণ
পর্যায় সারণী কাকে বলে এবং এর ইতিহাস
তেজস্ক্রিয় আইসোটোপের ব্যাবহার:
সুনিয়ন্ত্রিত ভাবে তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ ব্যাবহার করে বর্তমানে অসাধ্যকে সাধন করা সম্ভব হয়েছে। অল্প কিছু দিন আগেও মানুষ যেসব বিষয় নিয়ে চিন্তাও করতে পারত না তা এখন বাস্তবে রূপ নিয়েছে এই তেজস্ক্রিয় আইসোটোপের সঠিক ব্যবহারের কারণে।
নিচের ছকে কয়েকটি তেজস্ক্রিয় আইসোটোপের উদাহরণ দেওয়া হলো:
Isotope | আইসোটোপ |
---|---|
99Tc | টেকনিশিয়াম-99 |
131I | আয়োডিন-131 |
60Co | কোবাল্ট-60 |
32P | ফসফেট-32 |
153Sm | সামারিয়াম-153 |
89Sr | স্ট্রোনসিয়াম-89 |
238Pu | প্লুটোনিয়াম-238 |
131Cs | সিজিয়াম-131 |
192Ir | ইরিডিয়াম-192 |
125I | আয়োডিন-125 |
103Pd | প্যালাডিয়াম-103 |
106Ru | রুথেনিয়াম-106 |
ছকে উল্লেখিত কতিপয় আইসোটোপের ব্যাবহার নিচে দেওয়া হলো:
99Tc এর ব্যাবহার:
টেকনিশিয়াম-99 আইসোটোপের ব্যাবহার মূলত চিকিৎসা ক্ষেত্রে, রোগ নির্ণয়ে। এই তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ দিয়ে রোগাক্রান্ত স্থান চিহ্নিত করা যায়। প্রথমে ইনজেকশনের মাধ্যমে 99Tc শরীরের ভেতরে প্রবেশ করানো হয়। তারপর এই আইসোটোপ শরীরের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে জমা হয়। তারপর এইসব আইসোটোপের কাজ যেহেতু শক্তিশালী রশ্মি নির্গত করা, এক্ষেত্রে তা থেকে গামা রশ্মি বিকিরিত হয়। এই বিকিরিত রশ্মি, শনাক্তকরণ ক্যামেরা দিয়ে শনাক্ত করা হয় এবং সেখান থেকে বোঝা যায় শরীরের কোন অঙ্গে কোন ব্যাধি রয়েছে।
এছাড়াও দেহের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি নির্ণয় ও তার অবস্থান কোথায় এবং হাড় বৃদ্ধিতে কেন ব্যাথা অনুভব হচ্ছে তা সূক্ষাতিসূক্ষ রূপে নির্ণয় করা সম্ভব এই টেকনিশিয়াম-99 আইসোটোপ দ্বারা।
131I এর ব্যাবহার:
আয়োডিন-131 এক প্রকারের রোগ নিরাময়কারী আইসোটোপ। এর আগে আমরা টেকনিশিয়াম-99 কে দেখেছি সেটি একটি রোগ নির্ণয়কারী আইসোটোপ। তাই শিক্ষার্থী বন্ধুরা তোমাদের এ বিষয়টি একটু সতর্কতার সহিত পড়া উচিৎ।
আয়োডিন-131 আইসোটোপটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় থাইরয়েড ক্যানসার নিরাময়ে। এবং এই ক্যানসার নিরাময়ে উক্ত আইসোটোপের কার্যকরিতাও অনেক বেশি।
প্রথমত আক্রান্ত ব্যাক্তিকে 131আয়োডিন সমৃদ্ধ দ্রবণ পান করানো হয়। দ্রবণ পান করার সময় আইসোটোপটি থাইরয়েডে পৌঁছে যায়। তারপর সেখান থেকে শক্তিশালী বিটা রশ্মি নির্গত করে। এই বিটা রশ্মিই থাইরয়েডের ক্যানসার কোষ এবং ক্রিয়া-কলাপ ধ্বংস করে। সোজা কথায় বলতে গেলে, 131I থাইরয়েডের ক্যানসার কোষকলা বৃদ্ধি প্রতিহত করে ক্যানসার নিরাময়ে অংশগ্রহণ করে।
60Co এর ব্যাবহার:
কোবাল্ট-60 নামক এই তেজস্ক্রিয় আইসোটোপটির সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যাবহারটি হচ্ছে খাদ্য সংরক্ষণে ব্যাবহার। Co-60 আইসোটোপ থেকে গামা রশ্মি নির্গত হয়। আর এই গামা রশ্মি ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া মেরে ফেলতে সক্ষম। তাই বিভিন্ন প্রকার ফলমূল ও শাকসবজি সংরক্ষণে এই আইসোটোপ ব্যাবহার করা হয় যাতে সেখানে ব্যাকটেরিয়া জন্মে ক্ষতিসাধন করতে না পারে।
এছাড়াও মুরগির ব্যাকটেরিয়া জনিত রোগে 60Co ব্যাবহার করে তা দমানো যায়।
এর গামা রশ্মি ক্যানসার কোষ-কলা ধ্বংসে কার্যকরী। যেমন: 60Co টিউমার নির্ণয় ও নিরাময় উভয় ক্ষেত্রেই ব্যাবহৃত হয়।
32P এর ব্যাবহার:
ফসফেট-32 এর ব্যাবহার প্রধানত কৃষিক্ষেত্রে, ফসলের পুষ্টিতে। এ আইসোটোপের মাধ্যমে মূলত ফসলের পুষ্টি হয় না বরং আর কতটুকু পুষ্টি প্রয়োজন তা নির্ণয় করা যায়। তারপর সুনির্দিষ্ট পুষ্টি উপাদান বা সার ব্যাবহার করে আশানুরূপ ফলাফল লাভ করা যায়। প্রথমে তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ জমিতে দেওয়া হয় তারপর উদ্ভিদ তা মুলের মাধ্যমে শোষণ করে নেয়। তারপর শোষিত আইসোটোপ থেকে তেজস্ক্রিয় রশ্মি বের হয়। সবশেষে তা শনাক্ত করা হয় গাইগার মুলার কাউন্টার দিয়ে। এবং পরিমাপ করে নির্দিষ্ট অনুপাতে সার ব্যাবহার করা হয়।
- 238Pu ব্যাবহার করা হয় হার্টে পেইসমেকার বসানোর কাজে।
- হাড়ের চিকিৎসায় 153Sm অথবা 89Sr ব্যাবহৃত হয়।
- এছাড়াও বিভিন্ন প্রকারের ক্যানসার নিরাময়ে 131Cs, 192Ir, 125I, 103Pd, 106Rd ব্যাবহৃত হয়।
তেজস্ক্রিয় আইসোটোপের ক্ষতিসমূহ:
এতক্ষণ আমরা তেজস্ক্রিয় আইসোটোপের কিছু সুনিয়ন্ত্রিত ব্যাবহার দেখেছি। যা দিয়ে অনেক কঠিন কার্যক্রম সহজেই সম্পাদন করা যায়। তবে এই আইসোটোপের ব্যাবহার অনিয়ন্ত্রিত হলে অনেক ক্ষতি হয়ে যায়। যেমন: আমরা জানি, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ ব্যাবহৃত হয়। যদি কোনোভাবে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে কিন্তু এইসব তেজস্ক্রিয় আইসোটোপের শক্তিশালী রশ্মি দিয়ে মানুষ ও পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হয়। দেখা যায়, জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বিস্ফোরণের জন্য সেখানে আজও তেজস্ক্রিয় রশ্মি নির্গত হয়। যা মানুষকে বিকলাঙ্গ করে দিতে পারে। এজন্য তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ সঠিক ও সুনির্দিষ্ট ব্যাবহার একান্তই কাম্য।
আশা করি এই আর্টিকেলটা তোমার উপকারে এসেছে। এরকম আরো তথ্যবহুল পোস্ট পেতে ঘুরে দেখতে পারো এই সাইটটি। এখান থেকে তোমার বন্ধুও যেন কিছু জানতে পারে তার জন্য পোস্টটা শেয়ার করতে পারো।
এছাড়া এই তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ এবং তার ব্যাবহার সম্পর্কিত তোমার আর যেকোনো সমস্যা থাকলে কমেন্টে জানাতে পারো।
আমরা ভালো থাকবো - দেশকে ভালো রাখবো
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন